বাংলা ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবচন আছে, ‘চুলকে ঘা করা’। এটি সচরাচর শিক্ষিত কিংবা সংস্কৃতি মনস্ক মানুষের মুখে ব্যবহৃত হয় না। তথাকথিত অ-সংস্কৃতিবান অথবা আম জনতার মুখেই বেশি ব্যবহৃত হয়। কী জানি কেন আমার এই মুহূর্তে ওই প্রবচনটার কথাই মনে পড়ল। অবশ্য আমি যে বিশেষ সংস্কৃতিবান বাঙালি এমন দাবি করবার দুঃসাহস আমার কদ্যপি ছিল না।
আমরা অর্থাৎ বাঙালিরা নিজস্ব কোনো কিছু নিয়ে গর্ব করার দিন অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছি। আমার জীবদ্দশায় অন্তত তেমন কিছু চোখে পড়ে নি। তবে বাপ-ঠাকুদ্দার মুখে গল্প শুনেছি, বাঙালি নাকি ছিল এক সাংঘাতিক জাত আর তার গর্ব করার মত বিষয়ও ছিল নাকি ভুরি ভুরি। সে যাই হোক, বাপ-ঠাকুদ্দার কথা অবিশ্বাস করতে নেই। পাপ হয়।
গর্ব করার মত কিনা জানি না, তবে একটা ব্যাপার ছিল, সব ধর্মের মানুষের মিলে মিশে থাকার চেষ্টা। সেটা অবশ্য গর্বের বিষয় না লজ্জার তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে, অন্তত আজকের প্রেক্ষাপটে।
তার মানে এই নয় যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ বা অবিশ্বাসের বাতাবরণ ছিল না। ছিল, সুপ্ত হলেও অবশ্যই ছিল। কিন্তু বিগত চার দশকে সেই সন্দেহ বা অবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বাঙালিকে দ্বিধাবিভক্ত করতে পারে নি। চামড়া থাকলে ফুসকুড়ি হবেই। আর ফুসকুড়ি থাকলে তা মাঝে মধ্যে চুলকোবেও। কিন্তু সেটাকে চুলকে চুলকে ঘা করব কিনা তা অন্য প্রশ্ন।
আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় কলকাতার রাস্তায় মহরমের মিছিল দেখা ছিল আমার বিশেষ কৌতূহলের বিষয়। বড় হওয়ার পরও সেই কৌতুহল আমার যায় নি। তরোয়াল,ছোরা, লাঠি নিয়ে সেই মিছিল দেখে আমি আগেও মুগ্ধ হতাম, এখনও হই। কখনো আমার মনে হয় নি ভিন্ন ধর্মের একদল মানুষ আমাকে তার অস্ত্র দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছে। তরোয়াল উঁচিয়ে শিখদের মিছিল দেখেও কখনও তা মনে হয় নি। আজ হঠাৎ কী এমন ঘটল যে ‘দেখ, আমারও কত তরোয়াল আছে’ বলে রাস্তায় নেমে পড়তে হল!
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সামান্য হলেও অস্বস্তি নিয়ে বাঁচেন। একটা চোরা আতংক তাদের চেতন অথবা অবচেতনে বয়ে চলে । তাই তারা একজোট হয়ে থাকতে চান, থাকতে চান নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই।
কিন্তু পশ্চিমবাংলার চেহারাটা তো এমন ছিল না! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এখানকার মুসলমানরা অধিকাংশই দরিদ্র। আধুনিক শিক্ষা থেকেও তারা পিছিয়ে ছিলেন যুগ যুগ ধরে। তার কারণ বিশ্লেষণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল এটা বলা যে অধিকাংশ মুসলমানই ব্যস্ত থেকেছেন জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে। সেই জায়গায় সংখ্যাগুরু হিন্দু দরিদ্রদের সঙ্গে তাঁদের কোনো তফাৎ ছিল না, এখনও নেই।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে সর্বস্তরের মুসলমানের সঙ্গে মেলামেশার। ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত- অশিক্ষিত সব পর্যায়ের মুসলমান পরিবারের সঙ্গে আমি মিশেছি। নিজেকে সে কারণে যথেষ্ট ভাগ্যবানও মনে করি। কোথাও দেখিনি পরোধর্মের প্রতি বিদ্বেষ। বরং তাদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় কিঞ্চিৎ বিস্মিতই হয়েছি।
উল্টো দিকে বেশির ভাগ বাঙালি হিন্দু পরিবারে দেখেছি মুসলমানদের সম্পর্কে চাপা বিদ্বেষ। কিন্তু সে বিদ্বেষ ধর্মাচরণ ও খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে অধিকাংশ সময়েই। কখনোই তা বৃহৎ আকার ধারণ করে নি।
সব ধর্মের মধ্যেই কিছু শক্তি থাকে যাদের কাজ উস্কানি দিয়ে বিরোধ কে বাড়িয়ে তোলা। সেই শক্তিকে যদি মৌলবাদী শক্তি তকমা দিয়ে দিই তাহলে অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। মৌলবাদের বাইরেও এই জাতীয় শক্তি অবস্থান করে। সেখানেই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করার কথা ‘রাষ্ট্রের’।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আমাদের দেশে রাষ্ট্রশক্তি পরিচালিত হয় দলীয় রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের দাঁড়িপাল্লায় ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের কল্যানমুলক ভূমিকাকে পেছনে ঠেলে সামনে আবির্ভুত হয় রাজনৈতিক স্বার্থ। সেখানে শাসক বা বিরোধী কেউই নিজেকে পৃথক করতে পারে না।
মহরমের মিছিল হয় ঐতিহাসিক একটি যুদ্ধ ও সেই সংক্রান্ত বিয়োগান্তক ঘটনাকে স্মরণ করে। সেই মিছিলে প্রদর্শিত অস্ত্র সম্ভার ভিন্ন ধর্মাবলম্বিকে আতঙ্কিত করবার জন্য নয়। এমনকি সেই মিছিল আয়োজিত হয় মূলত শিয়া সম্প্রদায় দ্বারা। সমগ্র মুসলমান জাতি মহরমের মিছিল করে না। বছরের পর বছর ধরে বাংলার বুকে মহরমের মিছিল আয়োজিত হয়ে চলেছে। বড় কোন সমস্যা কখনও হয়েছে বলে জানা যায় না।
পাশাপাশি রাম নবমীতে অস্ত্র সহ শোভাযাত্রা বারাণসী অঞ্চলে প্রচলিত থাকলেও বঙ্গদেশে তার প্রাদুর্ভাব আগে দেখা যায় নি। একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ও তার অন্যান্য সংগঠন যে রে রে করে অস্ত্র হাতে রামের জন্মদিন পালন করতে নেমে পড়ল তার কারণ সম্পূর্ণ ভাবেই রাজনৈতিক মুনাফা লাভ করা। মূল গল্প হল সেই সাতাশ শতাংশ ভোট। সাতাশ শতাংশের এমনই মহিমা যে অস্ত্র মিছিলের মোকাবিলায় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলকেও এখন বলতে হচ্ছে,”রাম কি তোমার একার”? এবং ঘটা করে হনুমানজয়ন্তীও পালন করতে হচ্ছে।
সাতাশ শতাংশ ভোট পাওয়ার জন্য যারা সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের পাশাপাশি এমন বার্তাও দিয়েছেন,’তোমাদের সাত খুন মাফ’, তারা এটা বোঝেন নি যে লোহার বাসর ঘরের ওই ছিদ্রপথেই কালনাগিনী ঢুকে পড়তে পারে। আর আজ ঠিক সেটাই ঘটতে চলেছে। ভয়ঙ্কর কালনাগিনী ঢুকে পড়তে চাইছে। ভোট শতাংশের খেলায় সে দিকে কারো হুঁশ আছে কি?
আমি দেখেছি, মুখে উদারতার বড়াই করলেও অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসী মানুষই মনের গভীরে এই ধারণাই পোষণ করেন, ‘যাই বল বাপু, আমার ধর্মটাই সর্বশ্রেষ্ঠ, তোমারটা ওঁচা।’ আর সেই বিশ্বাসের গোড়ায় সুড়সুড়ি লাগলে তা যে অন্য আকার ধারণ করে তা বোঝা যাচ্ছে বাংলার অলিতে গলিতে রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল দেখে।
এর সমাধান কোথায় তা বলতে পারা খুবই কঠিন। ধর্ম আর রাজনীতি, রাজনীতি আর ধর্ম ক্রমশ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। জীবনানন্দের ভাষায়, অদ্ভুত আঁধার, যা ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়ার মত। হয়ত আগামী দোল পূর্ণিমাতে দেখতে হবে চৈতন্য জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে নগর সংকীর্তন সহযোগে। আর খোল-করতাল এর মধুর ধ্বনি মাতিয়ে তুলছে আকাশ-বাতাস।তারই মাঝে ঝলসে উঠছে দু’চারটে খোলা তরওয়ালের ধারালো ফলা। সেদিন হয়ত আমিও বলে ফেলব, ওরা অস্ত্র দেখালে যদি মামলা না হয় তাহলে আমার বেলা হবে কেন?
——-সুরথ রায়।