অক্টোবর ২২, ২০১৬
(কোহেনের শেষ অ্যালবাম শুনে)
লিওনার্ড কোহেন আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে ডিলানের চাইতে বেশি আপন (আহা, এই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বাইনারিটিতে বোধহয় শুধু বাঙালিরা দুষ্ট নয়) যেভাবে জঁ-লুক গোদার আমার কাছে অনেক বেশি আপন তিনিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্রকার না হলেও। না গোদার শ্রেষ্ঠতম নন, তিনি অনেকক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়েন, কিন্তু সেজন্যই তো, সিনেমাকে তার সীমানা থেকে পেরিয়ে নিয়ে যেতে হয়ই কান টেনে, ঘাড় ধরে – না হলে সিনেমা ব্যক্তিগত বা অভিপ্রেতর কাছাকাছি যাবে কি করে? আমার কাছে আশি পেরোনো গোদার এখন – আসলে চিরকালই – আবেগসর্বস্ব মানুষ, যার নিজের আবেগকেই সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে মেধার দেয়াল তৈরি করেন। ভাগ্যিস করেন, নাহলে সিনেমার সবচেয়ে সাহসী নিরীক্ষাগুলো আমরা দেখতে পেতাম না (খুব কম লোকেরই সে সাহস আছে, কনসিস্টেন্টলি নিরীক্ষা করার) – আশিতেও তরুণতম থাকতেন না।
লিওনার্ড কোহেনের আশি পেরিয়েও সেই ভয় নেই, নিজের আবেগের সম্মুখীন হওয়ার। সে তো তিনি শুরু থেকেই হয়ে আসছেন। পৌরুষকে, সত্ত্বাকে নির্মমতম এক্স-রে’র রশ্মিতে যদি কেউ ঝাঁঝরা করতে জানেন তার নাম লিওনার্ড কোহেন – যার কঙ্কাল তার কাব্যের মত নিরাবরণ ও সুন্দর। তিনি নিজের আবেগের, ভঙ্গুর অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়ান যেভাবে জনশুন্য ওয়াইল্ড ওয়েস্ট টাউনের পথের দুপ্রান্তে ডুয়েলে প্রতিদ্বন্ধ্বীরা। তিনি জানেন তার ভঙ্গুর অস্তিত্ব আগে হোলস্টারমুক্ত করবে রিভলবার, অথচ তিনিই বিদ্যুতগতিতে হবেন অব্যর্থ। নিজের আবেগের লাস পেরিয়ে যাবেন তিনি, নিজের অস্তিত্ত্বের লাসের দিকে এক লহমা তাকিয়ে টুপিটা খুলে নেবেন। কোহেনকে আবেগ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মেধার দেয়াল তৈরি করতে হয়না। তার গন্তব্য আবেগ থেকে নিরাবেগের দিকে।
You Want it Darker সেই মৃত্যুপরবর্তী নিরাবেগ নিরাসক্তিতে আচ্ছন্ন। সেই কবে Tower of Song-এ নিজের সার্টিফিকেট লিখেছিলেন তিনি I was born like this, I had no choice, I was born with the gift of a golden voice, এই অ্যালবামে নিজেকে নিয়ে সেরকম appraisal নেই। কবিত্ব বা গান নিয়ে কোনো ফিরে দ্যাখা নেই – এই অ্যালবামে এক নতুন প্রতিদ্বন্ধী, নতুন প্রেমিকা, নতুন সম্রাট, নতুন আততায়ীর সাথে তার মোলাকাত।
একবার মনে হবে তার নাম মৃত্যু, একবার মনে হবে ঈশ্বর – আসলে দুইজনেই – আবার আসলে তিনি নিজেও, আসলে এই মৃত্যুরূপী, ঈশ্বরপ্রতিম, নিকটতম আগন্তুক তিনি নিজেই। অর্থাৎ, আবার রাস্তার দুধারে হোলস্টারে রিভলবার নিয়ে দুইজন দাঁড়িয়ে – কবি ও কবির ভঙ্গুর অস্তিত্ব। শুধু এইবার অস্তিত্ব কবির হৃদয়ে অন্তিম বুলেটটি পাঠিয়ে দেবেন, তারপর দায়হীন, নিরালম্ব, হালকা, মুক্ত অস্তিত্ব – যার রিভলবারে একটি বুলেটই ছিল – কবির রিভলবারটি পরম আদরে তুলে নেবে। যেখানেও একটিই বুলেট অবশিষ্ট থাকার কথা। আততায়ীর আর কাউকে হত্যা করার নেই।
তারপর সেই বুলেটের সামনে গানের অপারে, কবিতার অপারে গিয়ে সেই অস্তিত্ত্ব বসবেন, আর বলবেন – তার কন্ঠে সুর অনেকদিনই বিগত, তার অমোঘ ব্যারিটোনে এখন নিটোল উচ্চারণ শুধু –
I’m sorry for the ghost I made you be
Only one of us was real – and that was me.
নভেম্বর ১১, ২০১৬
(কোহেনের তিরোধানের পর)
বলেছিলেন, গায়কের মৃত্যু অবধারিত – the singer must die – অথবা, মৃত্যু দন্ডিত হয় তার। কাল যার মৃত্যু হল, তাকে কেউ দন্ডিত করেনি। ইউএসএ-তে ডেমোক্রেসি এলো, তখন চলে গেলেন একজন – আমেরিকাতেই। তিনি ফেরারী হলেন।
কবির মৃত্যু হয়। ফুরিয়ে যাওয়া শিরা থেকে নিংড়ে নেওয়া এক একটি শব্দ বেরোলে মৃত্যু তো হওয়ারই কথা। এক একটা শব্দ বসতো রক্তের ফোটার মত – অমোঘ, অথচ শিশিরের মত ছেনালি তার, রোদ উঠলে উবে যাওয়ার হুমকি। সে সব শব্দ, ফেরারী হল।
সে তো কবির কথা। রিক্ত ভক্ত কি নিয়ে থাকবে? অশ্লীলের হুংকারে, ক্ষমতার ভাষার এ কোন কোলাহলে রেখে গেলে – কবি আমার? ঈশ্বর আমার?
সুর তো কন্ঠ থেকে কবে থেকেই ফেরারী হচ্ছিল, খান দেড়েক নোট লাগতো কন্ঠে। সেই কবে থেকেই তো কিন্নরীদের ভাঙা কাঁচের মত রিনরিন তাকে ঠেকনা দিয়ে রাখতো, যেভাবে কবিকে ধারণ করে রেখেছিলেন তার আজীবনের সঙ্গিনীরা। গায়ক যখন বৃদ্ধতর, তখন লিওনার্ড কোহেন ছিলেন শুধু উচ্চারণ, উচ্চারণই অস্তিত্ব।
অমোঘ ব্যারিটোন! যেভাবে তিনি ‘নেকেড’ বলতেন স্বেচ্ছায় নারীরা বসন খুলে দিতেন সেই কন্ঠ দেখবে বলে; যেভাবে তিনি ‘লর্ড’ বলতেন ঈশ্বর স্থানু হয়ে যেতেন নতজানু সেই কন্ঠের সামনে; যেভাবে তিনি ‘লাভার’ বলতেন আনমনাদের মাথা ঘুরে যেত সেই ডাকের দিকে। তার কন্ঠ, উচ্চারণ – অস্তিত্ত্ব হয়ে যেত শব্দময়। অস্তিত্ত্ব ফেরারী হল।
রিক্ত জীবিত এই রক্তময় বধিরতায় কি নিয়ে থাকবে – চিরজীবিত আমার? প্রেমিক আমার?
গানের আড়ালে রগড় শোনা যায়। যেতাম না – তিনি বলেন – বন্ধ হয়ে গেল যে সরাইখানা? বারটেন্ডার আরেক পেগ দিলে কি নিতাম না? মহিলা যদি আরেকটি কলি শুনতে চাইতেন, কপটে বলতেন সেরকম হয়নি – বাঁধতাম না আবার? ‘সেরকম’ই তো খুঁজে চলেছি। স্যাক্সোফোনিস্ট যদি বলতেন পর্দা মিলছে না – গলা খাকরিয়ে চেষ্টা করতাম না ফের? কিভাবে যাবো? গত কত দশক ধরেই তো প্রতি মুহূর্তে নাগরিক কোনো নিরালায় কোনো এক শ্রান্ত নারী বলতো – লিওনার্ড, যেখানেই থাকো, বলো – নেকেড, লর্ড, লাভার – এক পল’ও বিরাম পাইনি; আদেশ দিলে বিরাম হারাম হয় না কন্ঠের ক্রীতদাসের? কিভাবে যাবো? যদি একটি’ও মুহূর্ত আসে, যখন কোথাও, কোনো নাগরিক নারী নিরালায় বলছেনা – কোহেন, বলো … এক দন্ড, দু’দন্ড দেখে চলে তো যেতেই হবে যদি তারা অন্যরকম আনমনা হয়। এক লহমায় তাই হল কি? প্রেমিক ফেরারী হল।
রিক্ত পুরুষ হয়ে, আপনার উচ্চারণের অযোগ্য আকাঙ্খী নিমিত্ত হয়ে, লিওনার্ড হেটেরো ফাকার কোহেন – কি নিয়ে থাকবো তাহলে? এ কোন অতৃপ্তের কামনার বাজারে রেখে গেলে – পুরুষ আমার? বৃদ্ধ আমার? ম্যানহাটান নেওয়ার কথা ছিল, বার্লিনও।
ফিসফিস করে বলেন কোহেন – এ তোমাদের আজব ভ্রম! কাকে ফিরিয়েছি? সঙ্গিনীকে নিয়ে গান বেঁধেছি, তুমি গান হয়ে ওঠোনা কেন তাদের? নারীই ঈশ্বর, ঈশ্বরই ভালোবাসা, ভালোবাসাই মৃত্যুসমান। সভ্যতার গায়ে ফর্মালডিহাইডের গন্ধ, জ্যাজ ক্লাবে শেষ বুগি নাইট – বাইরে প্রস্তুত সশস্ত্র সেনানী – তোমার জন্য দ্বার বন্ধ আছে কি? এসো। সংরক্ষিত লাসের রাসায়নিক গন্ধের শরীরগুলো বাইরে নিথর; তৃপ্ত রমনের, শ্রান্ত নৃত্যের ঘামের গন্ধ ওরা সহ্য করতে পারেনা – তাও ওরা নিথর বাইরে, আদেশের আগে বুলেট ছুটবেনা। তাতে কি শেষ ওয়ালৎজ বন্ধ আছে ভেতরে? এই যে বৃদ্ধ রসিক তাদের মৃত্যুভয় জয় করার গান শোনাচ্ছে, যে গায়ক দন্ডিত – তোমার পৌরুষ কি তা শোনার অন্তরায়? কে বলেছে তোমার জন্য গাইনা? স্বয়ংক্রীয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেইসব সেনানী আদেশ পেলে গেটক্র্যাশ করবে, অথচ স্বয়ংক্রীয় নয় তাদের শরীর, তোমার শরীরে তো নাচ হয়? মুক্ত হওনা কেন তা’লে?
সৈন্য অপারেশন শেষ হলে দেখবে সভ্যতার আন্ডারগ্রাউন্ড জ্যাজক্লাবে কোনো কোহেনের লাস নেই। কোহেন ফেরারী।
এ কোন নির্বান্ধবে রিক্ত করে গেলে, বন্ধু আমার? বৃদ্ধ ব্যারিটোন ফিসফিস করে বলে – কিন্নরীরা যখন রিফ্রেন গাইছেন বাতাসে – নিকটতম স্পর্শ খোঁজো, নিকটতম শ্বাস, এখনো চুম্বন বাকি হাজার হাজার!
-অনিন্দ্য সেনগুপ্ত