১.
এতদিন পরেও তুমি সমুদ্রের গল্প বলো। আসলে ক্ষোভ, দিগন্তবিস্তৃত মরা পাথর, ফিরে গিয়ে দেখবে বালি হয়ে গেছে। দ্বিরাগমনের লাভাটে আলোয় তারাগুলো খানিক হাস্যকর ভাবে দুলে উঠতে শুরু করলে একে একে সব বিশ্বাস করা যায়- কি হয়েছে, কি হবার কথা ছিল। সেবারও ঈশ্বর খানিক ম্যানড্রেকের ভূমিকায়, বসা মাত্র রাস্তার ওপাশে আলোর রং বদলে যেতে লাগল, তোমাকে নামের মত করে চেনা তার পছন্দ হল না, ছবিওয়ালার ডাকে ফাঁকতালে জুটিয়ে আনা মাছ ফেলে পালাল জোড়া শঙ্খচিল। কিন্তু একরকম সুখ ছিল, বিশ্বাস করো, ঈশ্বর যত বাধ সাধে, ততবার মানুষ হতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মানুষ বড় ভয়ানক, সে গেলে ফিরে আসে অথচ কোনো জল পাথর ঘেঁষে বসে না, যতদূর চোখ যায়, বিপত্তি পুষে রাখি চুপচাপ। এ পালানো, এ ধরা না-পড়া ঠেকে শেখা, কেবল কথা বলতে বলতে নিজেকে শুনিয়ে নিলাম অর্বাচীনের মত। ডায়ালগ ফুরোলে যখন দু’টো পৃথিবী হাত ধরে.. তখন নিরুদ্দেশের কোলে কোথাও একটা ছেলে ঠান্ডা মাথায়, ভিতর ভিতর অগ্ন্যুৎপাতকে সাক্ষী রেখে জলের হাতে ছুরি তুলে দিতে চাইছে।
২.
তেমন কাউকে পেলে এতদিনে আলো উপহার দিতে। কারণ আলোর একরকম দাগ থাকে। কেউ নিজে থেকে এসে জ্বেলে দিতে পারলে তাই খুশি হও। উল্টে রাখা প্রদীপের পাশে বসে ওরা সর্ষেফুলের গল্প শোনায়। একসময় নেশাগ্রস্ত কাউকে ফিরিয়ে আনতে বিনা কথায় বাড়ি ছাড়ে। রাস্তা পেরোতে পেরোতে মানুষের চোখে পড়ে যায়। হাসে। আপনমনে কাঁদে। রাস্তা ছাড়ে না। ফিরে এসে দু’জনকে খেতে দেয়। পোশাক খুলে ফেললে মনে হয় গোলকধাঁধা। আসলে শরীর।
এত কিছু থাকতে তাই আলো বানাও। মাঝেমধ্যে দু’টো রং গায়ের জোরে ছিটকে কোথাও যত্নে আঁকা বরফকুচির ওপর এসে পড়ে, মনে হয় একটু গলতে দিলে ভাঙা-গড়ার সমস্ত বিবাদ মিটে যেত। আলোর আড়ালে তোমার অন্য কোনও পরিচিতি ঢাকা পড়ার সময় এসে যেত ততক্ষণে। এখন আসবে না। বরং বেলা পড়ে এলে ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে তলোয়ার খুলে ফেলার সময় থাকার পুরনো কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেবে কেউ। যে-থাকা বলতে বোঝায় খালি আলোর জন্য থাকা।
৩.
ধরা যাক, সমান্তরাল কোনও পৃথিবীতে এখন লোডশেডিং। মানুষের মুখ আপাতত মানুষের মত না-দেখালেও কেউ কাঁদছে না, এমনকি মানুষও।
কোথাও একটা হঠাৎ বাজি পোড়ে। বেওয়ারিশ কতগুলো ফুলকি অন্ধকারের খবর পেয়ে এতটা পথ দৌড়ে আসে। ঝিল চোখে তুমি প্রেক্ষাপট খানিক কালো করে ফের ঘেন্নায় মন দাও। আলো হতে না দিয়েই। একেকটা বজ্জাত তবু এদিকেই এসে পড়ে, পাল্লা নাড়ে আর পিদ্দিমের ভিতরের মাটি কেঁপে ওঠে। অভিশপ্ত! এইমাত্র ফিরে এল সলতে সেজে, এদিকে বাসি তেলও আগুনের খবর রাখতে ভুলে গেছে কতদিন হল। তুমি দেখেও দেখোনি, বলা ভালো অন্ধ সেজে বসে ছিলে কখন সকাল হবে আর পোড়া দুর্নাম সাত পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে সশব্দে! কিন্তু রাখা কথার ভার বড় দায়, পাড়া কোন মরণকাঠি আগলে বিশ্বাসঘাতকের মত দরজা জানালা সব এঁটে দিয়েছে, আসলে তুমি খবর না-রাখলেও অন্ধকারের অমোঘ ক্যাথিড্রালে তোমার হয়ে তোমার জন্যই রাখা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এতক্ষণে নিঃশব্দে সরে গেছে অন্য কেউ। তুমি মুখ ফিরিয়ে অন্যমনে আলোর জাহাজ চলে যেতে দেখছিলে ভরা বন্দরে, অথচ একরকম তান্ত্রিক আঙুল তুলে সবক’টা বাতিঘর জ্বেলে দিতে পারত সে-ই। অথচ এখন আর কিছু থাকলেও আলো নেই, তোমার ঘেন্নাগুলোও ক্রমাগত পথ হারাচ্ছে এপারে আসতে গিয়ে। তাদের পথ দেখানোর কেউ নেই, কোনও এক ইন্টারস্টেলার বেইমানির শিকার হচ্ছে সমস্ত যোগাযোগ, বাজি পুড়ছে অথচ আলো এতটুকু দাঁড়াচ্ছে না। আসলে আলোর মত করে কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখেনি বোধহয়। তোমার চোখে ঝিল কেঁপে ওঠে, অথচ তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আলো জেগে নেই। অন্ধকার ছিল। থাকে। অথচ অন্ধকার থেকে এতদূরে একটা পৃথিবীতে বসে থেকে আমি মনে করতে পারি না, কে যেন বলেছিল, “সন্ধ্যেবেলার ল্যাম্পপোস্টগুলো অন্তত দাঁড়িয়ে থেকে শ্যামাপোকাদের রুদালি শোনে..”
Poetry: Arkaprabha Roychowdhury
Illustrations: Subarnarekha Pal