কল্পবিজ্ঞান বললেই আমরা যেগুলো ভেবে নিই, সেগুলো হলো – মহাকাশ, উড়ন্ত যানবাহন, হরেকরকমের যন্ত্রপাতি, রোবট, অদ্ভুত আকৃতির আর্কিটেকচার, আর বিজ্ঞানে সাবলীল, অতি উন্নত মানবজাতি। ২০২১– এ এসে নতুন করে কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞা বা উদাহরণ, কোনোটাই দেওয়া আর মানায় না। কাতশুইরো ওতোমোর আকিরা অনুযায়ী আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে এক নতুন পৃথিবীতে চলে এসেছি। বিদেশে কল্পবিজ্ঞান লেখা শুরু হয় প্রায় ২৫০ বছর আগে। বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের মোটামুটি স্থায়ী সূচনা হয় অদ্রীশ বর্ধনের আশ্চর্যের হাত ধরে। তারপর ক – বি* এর নাট্যমঞ্চে আবির্ভাব হয় প্রফেসর শঙ্কুর। সত্যজিৎ রায়ের সে কী সৃষ্টি! কতরকমের অ্যাডভেঞ্চার। বাংলায় তারপর এই ধাঁচের ছোট বড়ো অনেক গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। শিশু ও কিশোর ম্যাগাজিন গুলোয় মাঝে মাঝেই রহস্য, ফ্যান্টাসি সংখ্যার সাথে সাথে কল্পবিজ্ঞান সংখ্যাও প্রকাশিত হয় (যদিও তা অনুপাতে অনেক কম)। এছাড়া, অনলাইন ব্লগ কল্পবিশ্ব বাংলার সাই–ফাই ‘সিন‘ ধরে রাখার জন্য অসাধারণ কাজ করছে।
বেশ কিছুদিন আগে লেখক এবং শিক্ষক সলিল বিশ্বাস সম্পর্কে কিছু লেখা পড়ি। সেখানে জানতে পারি ওনার লেখা বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান গল্প আছে। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষায় যাতে পাঠক কিছু ক–বি ক্লাসিক পড়তে পারে তার জন্য তিনি আইজ্যাক আসিমভ, আর্থার সি ক্লার্ক এর মত লেখকদের বেশ কিছু গল্পও অনুবাদ করেছেন।২০১৯ এ প্রকাশিত, তাঁর খোয়াবওয়ালা ও আরো বারো সংকলনে বেশ কিছু অরিজিনাল ও অনুদিত কলবিজ্ঞান গল্প আছে। সেই বই নিয়েই এই আলোচনা। প্রথমে ভেবেছিলাম বেশ একটা ক্রিটিক্যাল রিভিউ লেখা যাবে। কিন্তু একটা করে গল্প পড়তে পড়তে আমার সাধারণ একটা রিভিউ লেখার মত তুচ্ছ কাজের প্রতি অনীহা চলে আসতে থাকে। কারণ, আমি যে সাহিত্য পড়ছিলাম, সে সাহিত্য রিভিউ এর অনেক উর্ধ্বে।
বইতে তেরোটা গল্পের মধ্যে পাঁচটা টা অরিজিনাল আর বাকি আটটা অনূদিত। আমি প্রথম থেকেই শুরু করলাম। প্রথমেই বলে রাখি আমি ‘Spoiler’ জাতীয় কিচ্ছু দেবোনা কেননা আমি চাই সবাই যেনো বইটি পড়ে। আমি সাধারণ কিছু কথা বলবো, বেশিরভাগটাই হবে, আমাকে বইটি কী ভাবে অভিভূত করেছে সেটা নিয়ে।
বাংলার সাই ফাই এর কিছু সাধারণ প্যাটার্ন আছে। আজও সেই প্যাটার্ন মেনেই গল্প লেখা হয়ে চলেছে। বেশিরভাগ গল্পই অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে। অনীশ দেব বেশ কিছু গল্পে সেই প্যাটার্ন ভেঙেছেন। সেটা বোধহয় সারাজীবন কল্পবিজ্ঞান আর উইয়ার্ড ফিকশনে নিজেকে অতিবাহিত করে দেওয়ার ফল। অনেক বাংলা ক–বি গল্প ওনেক ধরনের ভাঙ্গা গড়ার মদ্ধ্যে দিয়ে গেছে, তাও, সাই ফাই জগৎ মানেই একটা ভীষণ অন্যরকম মানবজাতির ধারণা। গল্প গুলো ‘world-building’ নিয়েই অনেকটা সময় খরচ করে ফেলে। পরিবারতন্ত্র, ফিমেল সেক্সুয়ালিটি, রাষ্ট্রতন্ত্রের কিছু সদৃশ দর্শন গল্পে দেখা যায় যেগুলো বিদেশি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত। খোয়াবওয়ালা তে লেখক সেগুলোর বাইরে গিয়ে এক অনন্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন– একদম নিখাদ কল্পনা আর সারিয়াল ভিশন দিয়ে তৈরি এক জগৎ, যেখানে কমন প্যাটার্ন গুলো প্রাথমিক হয়ে ওঠেনি। গল্প গুলো কী ভীষণ গভীর জীবনদর্শন নিয়ে গড়ে উঠেছে! সংকলনে গল্পগুলি কোনো মারাত্মক রকমের ব্যাপার স্যাপার বা আপোক্যালিপ্টিক কিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, বরং গল্পগুলো খুব সামান্য মুহূর্ত বা সামান্য চিন্তা ভাবনার চারপাশে গড়ে উঠছে। সেই অর্ডিনারির মধ্যে এক্সট্রাওরডিনারি খুঁজে পাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্প আর পাঠকের মূল্য। ” ট্রফি ” গল্পটি আমার মনে হয়েছে মানবজাতির হামার্শিয়াকে উৎসর্গ করে লেখা। “খোয়াবওয়ালা” গল্পটি স্বপ্ন দেখা নিয়ে। গল্পটা যেন বিরাট রকমের কোনো প্যারাডাইম শিফট ঘটার আগে মানবজাতির হাতে ধরে রাখা একটা চিরকুটের মতো – যে চিরকুটে ছোট করে লেখা “ভুলে যেও না” কারণ বিস্মরণ ভবিতব্য। এবার আসি আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পটির কাছে – “আগন্তুক“। একটা কথা বলে রাখি, আমার কল্পবিজ্ঞান পড়া শুরু ‘শুকতারা‘ থেকে। তারপর আসতে আসতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও তারপর হতে আসে জুল ভার্নের জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দি আর্থ। সব গল্পই কিন্তু তখন বাংলায় পড়েছিলাম তাই বাংলায় সাই–ফাই পড়ার অভিজ্ঞতা ছোটবেলা থেকে আছে। কিন্তু “আগন্তুক” এর মতো, সাই ফাই ছেড়ে দিলাম, এমনকি কোনো গল্পই বাংলায় আজ অবধি পড়িনি (আমার ইগ্নোরেন্স)। মাঝে জ্যানেট উইনটারসনের দ্য স্টোন গডস পড়েছিলাম। ইটালো ক্যালভিনোর দ্য কস্মিকমিকস পড়েছিলাম। এই গল্প গুলো পড়ে সাবলিমিটির সংজ্ঞা নতুন করে বুঝেছিলাম। আগন্তুক পড়ে সেই সংজ্ঞা আরো নতুন করে বুঝলাম। গল্পটা পড়ার পর চুপ করে বসেছিলাম। কী আশ্চর্য, কী অসাধারণ গল্প। আগন্তুক পড়তে পড়তে আমার খুব ডেনিস ভিলন্যুভের আরাইভ্যাল মনে পড়েছে। গল্পটিকে আমি ‘কসমিক রোমান্টিসিজমের ‘ এর পর্যায়ে ফেলবো। যদিও এমন কোনো ‘literary’ টার্ম এখনও নেই। কিন্তু কসমিক হরর–এর কাল্পনিক উপপর্যায়ে ফেলতে কী অসুবিধা! এবার সবচেয়ে অদ্ভুত গল্প টাকে নিয়ে বলি– নর্গ নক্ষত্রের ক্ষহক গ্রহের ক্ষ্রক্ষ্র। গল্পটা বেকেট কিংবা সা্র্ত্রের উটকো সব গল্প– নাটক মনে করিয়ে দেয়। যেহেতু স্পয়েলার দেবো না, তাই শুধু বলে রাখি যে গল্পটির “ন্যারেটিভ” ভীষণ মজাদার। গল্পের কথক পাঠককে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিচ্ছে গল্পের মধ্যে এক অদৃশ্য চেয়ারে। একটা বেশ অদ্ভুত বর্ণনা দিয়ে গল্পটার ভাব আর চরিত্র বোঝাতে পারলে খুব খুশি হবো–সেটি এই যে, এই গল্পটা সবচেয়ে ভালো পরিচালনা করতে পারবেন টাইকা ওয়াইটিটি।
এরপর আসি অনূদিত গল্পে। বাংলা ভাষার চর্চা যে এখন কমে গেছে। এ নিয়ে তর্কতর্কী করে বিশেষ লাভ নেই। খোয়াবওয়ালা যদিও সেই তর্ক থেকে বহুদুরে। কিন্তু বিদেশি গল্পগুলিকে লেখক সুন্দর করে নিজের বানিয়ে নিয়েছেন। কী সাবলীল ভাষায় গল্পগুলোকে অন্য ভাষার দেহ থেকে, বাংলা ভাষার দেহতে নিয়ে এসে নতুন প্রাণ দেওয়া হয়েছে। লেখক গল্পগুলোকে রেফিউজি হতে দেন নি। আরও পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে।
শেষ কিছু কথা না বললে লেখাটা ছোট গল্পের মতো শেষ হয়ে যাবে কিন্তু শেষ হবে না। এই শেষ কিছু কথা আমি রাখবো লেখককে নিয়ে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে লেখক সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। কিছু রিগ্রেট মানুষের থেকে যায়। আমার ক্ষেত্রে অনেক রিগ্রেটের একটা হলো লেখক সলিল বিশ্বাসের সাথে দেখা/কথা না হওয়া। লেখক হিসাবে, শিক্ষক হিসাবে অনেক গল্প এখন পড়ছি, শুনছি। বইয়ের শেষে পরিশিষ্টে লেখকের নিজের প্রবন্ধ আছে, পড়ে ভীষণ ভালো লেগেছে। অনেক কাঠ–কাঠ অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধের চেয়ে ঢের ভালো।
যে কসমিক শক্তির কথা উনি লিখেছেন, আশা করি তিনি তাদের সাথে ভালোই আছেন।
*ক–বি – কল্পবিজ্ঞান
