“তারপর ভাই, এতদিন পর এখানে?”
“এই আর কি”
কবির ভাষায় “পোলাইট মিনিংলেস ওয়ার্ডস” । ঠিক যতটা আলাপ প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে দেখা হলে করা যায়, এই জায়গাটার সাথে আমার সম্পর্ক এখন ঠিক ততটাই । স্কুটি থেকে নেমে সেন্ট জোসেফস কনভেন্টের দিকে হাঁটা লাগালাম । বামদিকে তাকালেই যথাপরিচিত বিশাল গাছ, যা আমার জন্মের আগের কথা আমার পরবর্তী প্রজন্মকে বলতে চাইবে । সামনে গিয়ে বামদিকের বৃদ্ধ বেঞ্চগুলোর দিকে তাকালে সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যখন অল্প বয়সেই এক প্রাচীন বন্ধুর সাথে বৃদ্ধের আলোচনা করতাম, হাতে সিগারেট নিয়ে, একটানা, একনাগাড়ে । মুখোমুখি দাবার দান শেষ হলে রাজা, রানী, বোড়ে সব এক বাক্সতেই ঘুমিয়ে পড়ে ।
“দাদু আজকে তোমার দিন নয়” ।
প্রত্যেক দিন একনাগাড়ে পরাজয়ের হতাশা গিলে নেবার পর দাদু যখন ইচ্ছা করে একদান হেরে যায়, তখন অনার্স পাঠরত যুবকটির মনে নিদারুণ আনন্দ জাগে । কিছু খেলায় গড়াপেটা হওয়া ভাল, কারণ তাতে যে আনন্দ হয়, সেই আনন্দ যীশুর পুনর্জন্মের চেয়েও এই যুবকটির কাছে বেশি উপভোগ্য – এই কথা দাদুরা তাড়াতাড়ি বুঝে যান । আমরা তখন নিতান্তই যুবক, জানতাম কম, বুঝতাম আরও কম । তখন পাতাঝরার মরশুম । দাবার সাদাকালো বোর্ডে সকলের অজান্তে, অলক্ষ্যে বিধাতাপুরুষ এক ফলক কমলা-বাদামী কৃষ্ণচূড়া পাতা রেখে যাবার লোভ সামলাতে পারেন না । আমরা তখন সবে সেক্সপিয়র মহাশয়ের সেভেন স্টেজেস অফ লাইফ পড়েছি, অনুভব করিনি । ফলত, আমরা বয়সের আগেই সোলজার, এবং বয়স পেরোনোর পর প্রেমিক হতে শুরু করলাম ।
“রবিন দা, দুটো চা, একটা ফিল্টার উইলস, ছোট টা”
“এখনও একই ব্র্যান্ড?”
“এখানে এলে একই চা যখন খাই, তখন…”
অনন্তকালের কম ফ্লেমের লাইটারে অতিষ্ঠ হয়ে রবিন দা শেষমেশ হিটার ইন্সটল করেছে – আমার ধরাতে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি হয় । দেড় কিলোমিটার জুড়ে হাজার হাজার স্মৃতির কফিন – কোনটায় ফুল দেব আমি বুঝে না পেয়ে ফিল্টার উইলসে মন দিলাম । কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছাড়িয়ে খানিক এগোতেই ডানদিকে চোখ চলে গেল – এই জায়গাতেই তো আমার এক বন্ধু একটি মেয়েকে গোলাপ ফুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করে এবং সেই গোলাপ ফুলের পাপড়ি আরেকটি ছেলে চিবিয়ে খেয়ে নেয় । ব্যাপারটা সিম্বোলিক নয়, লিটারাল – খুব হেসেছিলাম সেদিনকে ।
হাসতে হাসতে হঠাৎ এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল – “আচ্ছা ভাই তোর জীবনে স্বপ্ন কি?” কল্পনার কাঁচের উপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলাম “একদিন আমি আয়ারল্যান্ড যাব, সেখানে এক চেস্টনাট গাছের ছায়ায় বসে শরতের মেঘ দেখতে দেখতে কবিতা লিখব” । তখন কি ভেবেছিলাম যে এই কথাটা যাকে বলব সে মনে রাখবে না? বরং মনে রাখবে এমন কেউ যার থেকে এই স্মৃতিচারণ আশাই করিনি? তখন কি ভেবেছিলাম যে চেস্টনাট তো পরের কথা, এই কৃষ্ণচূড়া গাছটাই আমার থেকে একদিন এক আলোকবর্ষ দূরে চলে যাবে – এমন এক নিভৃত কোলাহলে যেখান থেকে আমার নিভৃতি তার নাগাল পাবে না?
“তা দাদা তোমার ফেভারিট লেখক কে?”
“জয়েস, সর্বদা জয়েস।”
“কেন”
“কারণ লিভারের জ্বরের সময় যখন আমি আমার প্রিয় জায়গাটায় যেতে পারতাম না, তখন দূরদেশে থাকা একটা লোক তার প্রিয় জায়গার বর্ণনা যেভাবে লেখার মাধ্যমে দিয়ে গেছেন, সেটার সাথে আমি সবসময় নিজেকে রিলেট করার চেষ্টা করি।”
কলেজের পুরাতন বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে সোজা হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেলাম – বরফি কাটা বীথিপথেও ক্ষয় ধরে যায়, আর ক্ষয়ে যাওয়া চামড়ার চটি তা চিনতে পারেনা । পুরাতন পাঞ্জাবী ছিঁড়ে যায় কোমর থেকে, কপালে মরুভূমি প্যাস্টেল কালারের টান দিতে শুরু করে । আর ঠিক সেই সময়েই নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নগুলো নিজেদের ধরণ বদলে ফেলে । “যদি আমি সেইদিন এইটা না করে ওইটা করতাম, তাহলে কি আজ দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের সম্মুখীন করতাম নিজেকে?” প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা হল হঠাৎ, আকশে ঘনঘটা দেখে সেই প্রলোভন থেকে নিজেকে বিরত করা গেল ।
কলেজের গেটের সিকিউরিটি গার্ড, সদা যুবক মহানন্দ দা, রবীন্দ্রভবন, থানা, পাখিদের বিষ্ঠাক্রিয়ার জায়গা পেরিয়ে সেখানে উপস্থিত হলাম যেখানে সন্ধ্যেবেলা তাসের আড্ডা বসে আর এখনও পাঁচ টাকায় অপূর্ব ঝালমুড়ি পাওয়া যায় । ঝরে যাওয়া পাতা গুলো ততক্ষণে আমার নজর এড়িয়ে পদপৃষ্ঠ হয়ে গেছে । আসলে তখনও নিতান্তই যুবক – সূর্যের আলো গিলে খাবার জোশ না থাকলেও চিবিয়ে খেতে রাজি তখনও ।
কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতেই বাবার সেই চোখরাঙ্গানির কথা মনে পড়ে গেল যা প্রথম দিন মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে মনে হয়েছিল । আসলে কিছু জিনিস বদলায় না । তবে এতগুলো বছরের পর বাবা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । আমি হইনি । আমি কোথাও এখনও সেই পাঁচ বছর আগের বীথিপথ আর বেঞ্চের ধারেই পড়ে রয়েছি, কোনও এক মৃত আত্মার মত, যার স্মৃতি দাফন পায়নি ।
মাঝে মাঝে, চোখের শুষ্ক ভাব দেখে মনে হয়, আমি যৌবনের সাথে সাথে ক্রন্দনের অধিকার টুকুও হারিয়ে ফেলেছি ।
Soumabho Chakraborty
